কোনো কিছুকে দূরে সরাতে চাইলে আমরা সেটাকে ঠেলি বা ধাক্কা দিই। আবার কোনো কিছুকে কাছে আনতে চাইলে আমরা তাকে টানি। কোনো বস্তুর উপর অন্য বস্তুর ধাক্কা বা টানাই হচ্ছে বল প্রয়োগ। যখনই আমরা কোনো কিছুকে ঠেলি বা টানি, উঠাই বা নামাই তখন আমরা আসলে বল প্রয়োগ করি। যখন কোনো কিছুকে মোচড়াই বা ছিঁড়ি, প্রসারিত করি বা সংকুচিত করি, তখনো বল প্রয়োগ করতে হয় কিন্তু এই অধ্যায়ে আমরা শুধু বলের মাধ্যমে গতি পরিবর্তনের বিষয়টি আলোচনা করব। আমরা সবাই দেখেছি স্থির বস্তুর উপর বল প্রয়োগ করা হলে সেটি নড়ে আবার নড়তে থাকা বস্তুর উপর বল প্রয়োগ করে সেটি থামানো যায়। অর্থাৎ বল প্রয়োগ করে বস্তুর গতির পারিবর্তন করা যায়। বিজ্ঞানী নিউটন বল, ভর, জড়তা ও গতির মধ্যে সম্পর্ক স্থাপন করে তিনটি সূত্র প্রকাশ করেন। এই তিনটি সূত্র নিউটনের গতিবিষয়ক সূত্র নামে পরিচিত। নিউটনের প্রথম সূত্র থেকে আমরা বস্তুর জড়তা ও বল সম্পর্কে ধারণা পাই।
এ প্রসঙ্গে নিউটনের প্রথম সূত্র হলো:
বাইরে থেকে কোনো বল প্রয়োগ না করলে স্থির বস্তু স্থিরই থাকবে এবং সমবেগে চলতে থাকা বস্তু সমবেগে চলতে থাকবে।
নিউটনের প্রথম সূত্রের প্রথম অংশ নিয়ে কারো সমস্যা হয় না, কারণ আমরা সব সময়েই দেখেছি স্থির বস্তুকে ধাক্কা না দেওয়া পর্যন্ত সেটা নিজে থেকে নড়ে না, স্থির থেকে যায়। দ্বিতীয় অংশটি নিয়ে সমস্যা, কারণ আমরা কখনোই কোনো চলন্ত বস্তুকে অনন্তকাল চলতে দেখি না। ধাক্কা দিয়ে কোনো বস্তুকে গতিশীল করে ছেড়ে দিলেও দেখা যায় কোনো বল প্রয়োগ না করলেও শেষ পর্যন্ত বস্তুটা থেমে যায়। আমাদের দৈনন্দিন জীবনের অভিজ্ঞতা থেকে মনে হয়, যেকোনো কিছুকে সমবেগে চালিয়ে নিতে হলে ক্রমাগত বুঝি সেটাতে বল প্রয়োগ করে যেতে হয়। নিউটনের প্রথম সূত্র থেকে আমরা জানতে পেরেছি সেটা সত্যি নয়, সমবেগে চলতে থাকা কোনো বস্তু যদি থেমে যায় তাহলে বুঝতে হবে সেখানে কোনো না কোনোভাবে বল প্রয়োগ করা হয়েছে। ঘর্ষণ, বাতাসের বাধা এ রকম অনেক কিছু আসলে উল্টো দিক থেকে বল প্রয়োগ করে চলমান একটা বস্তুকে থামিয়ে দেয়। যদি সত্যি সত্যি সব বল বন্ধ করে দেওয়া যেত, তাহলে আমরা সত্যিই দেখতে পেতাম সমবেগে চলতে থাকা একটা বস্তু অনন্তকাল ধরে চলছে।
আমরা আমাদের দৈনন্দিন অভিজ্ঞতা থেকে দেখি, প্রত্যেক বস্তু যে অবস্থায় আছে, সে অবস্থায় থাকতে চায়। বস্তু স্থির থাকলে স্থির থাকতে চায় আর গতিশীল থাকলে গতিশীল থাকতে চায়। বল প্রয়োগ না করা পর্যন্ত বস্তু যে অবস্থায় আছে, সেই অবস্থায় থাকতে চাওয়ার যে প্রবণতা, সেটাই হচ্ছে জড়তা। স্থিতিশীল বস্তুর স্থির থাকতে চাওয়ার প্রবণতাকে বলে স্থিতি জড়তা এবং গতিশীল বস্তুর সমবেগে গতিশীল থাকার প্রবণতাকে বলে পতি জড়তা।
জড়তার ব্যবহারিক অভিজ্ঞতা
থেমে থাকা বাস হঠাৎ চলতে শুরু করলে বাসযাত্রীরা পিছনের দিকে হেলে পড়েন জড়তার কারণে । বাস যখন থেমে থাকে, তখন যাত্রীর শরীরও স্থির থাকে। কিন্তু হঠাৎ বাস চলতে শুরু করলে যাত্রীদের শরীরের বাসের সিটে বসে থাকা বাসসংলগ্ন অংশ গতিশীল হয় কিন্তু শরীরের উপরের অংশ জড়তার জন্য স্থির থাকে এবং স্থির থাকতে চার বলে পিছনে হেলে পড়ে।
চলন্ত বাস থেকে নামতে পেলে ঠিক তার বিপরীত ব্যাপারটি ঘটে। পুরো শরীরটি গতিশীল অবস্থায় পা যখন মাটি স্পর্শ করে, তখন শরীরের নিচের অংশ স্থির হয়ে গেলেও উপরের অংশ গতিশীল থেকে যায় এবং যাত্রী সামনে হুমড়ি খেয়ে পড়ে যায়।
একক কাজ:
একটি গ্লাসের উপর একটা কার্ড, বোর্ড বা শক্ত কাগজ রেখে তার উপর করেন রাখ। (চিত্র: ১০.০১)। হঠাৎ কার্ডটিকে জোরে টোকা দাও। কী দেখলে?
কয়েনটি প্লাসের মধ্যে পড়ে গেল কেন? হঠাৎ জোরে টোকা দেওয়ার জন্য কার্ডটি সরে গেল, কিন্তু জড়তার কারণে কয়েনটি তার নিচ্ছ স্থির অবস্থান বজায় রাখতে চাওয়ার জন্য গ্লাসের মধ্যে পড়ে গেল।
পাড়ি চালনার সময় গাড়ির সব আরোহীকে পতি জড়তার বিপদ থেকে রক্ষা পেতে সিটবেল্ট পরতে হয়। সিটবেল্ট ছাড়া চলমান গাড়ির চালক যদি হঠাৎ ব্রেক করেন, কিংবা দুর্ঘটনার মাঝে পড়ে তখন জড়তার কারণে তিনি সামনে ঝুঁকে পড়বেন এবং স্টিয়ারিং কিংবা উইন্ড স্ক্রিনে আঘাত পাবেন (চিত্র ১০.২)। চিত্রের দ্বিতীয় অংশে দেখা যাচ্ছে, সিট বেল্ট চালককে উইন্ড স্ক্রিনে আঘাত পাওয়া থেকে রক্ষা করছে। কোনো বস্তুর দিক পরিবর্তনের ক্ষেত্রেও আমরা জড়তার প্রভাব অনুভব করি। যদি কোনো বাস বা গাড়ি হঠাৎ বাঁক নেয়, তাহলে যাত্রীরা অন্য পাশে ঝুঁকে পড়ে। এর কারণ আরোহীও বাস বা গাড়ির গতির দিকে গতিশীল ছিলেন, বাস বা গাড়ি হঠাৎ দিক পরিবর্তন করলেও জড়তার কারণে আরোহীর মূল দিক বজায় রেখে গতিশীল থাকতে চান, তাই বাসের সাপেক্ষে অন্য পাশে সরে যান।
আরও দেখুন...